প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
জনম–১৯শেজানুয়ারী ১৯৩৫ । প্রয়াণ ১৫নভেমবর ২০২০
গতকাল ছিল মহা শ্যামাপূজার মহাসমারোহ আর দীপাবলীর আলোকে আলোকিত ভুবন। টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছিলো সতীর নানান পীঠস্থানের নানান মাহাত্ম্য ও পৌরাণিক বর্ননা।যেগুলি দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে কেটেও গিয়েছিল সারাটা দিন এবং মধ্যরাতের সময় পর্যন্ত।তার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ ভেসে আসছিলো ফেলুদা অর্থাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। আমরা জানি উনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ এবং কোলকাতার এক আরোগ্য নিকেতনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধরত।
আজ দিনের শুরুটা অন্যান্য দিনের মতোই হয়েছিল। কিন্তু দুপুর বেলা দুঃসংবাদটি ধেয়ে এলো তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। প্রানের ভিতরটা যন্ত্রনায় হু হু করে উঠলো বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই মহীরুহের পতনের সংবাদে।
বাংলা ছবির পর্দায় তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ অপুর সংসার ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। সেই সময় ছিল বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ। তখন ক্যালকাটা মুভিটোন,নিউ থিয়েটারস, টেকনিশিয়ান ইন্দ্র পুরী স্টুডিও গুলি ছিল বিপুল নক্ষত্র খচিত আকাশের মতো ই উজ্জ্বল আর ছিলেন দিকপাল অভিনেতা অভিনেত্রীরা এবং পরিচালকেরা যাদের সোনার কাঠির স্পর্শে এক একটি ছবি হয়ে উঠতো ইতিহাস।
সেইরকমই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও বাংলা ছবির জগতে প্রবেশ করে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন।
তাঁর অভিনীত ছবি অনেক।তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ছবির নাম করা যেতে পারে যেমন—ঝিন্দের বন্দী, অরন্যের দিনরাত্রি, চারুলতা, স্ত্রী, অভিযান, আকাশকুসুম, বসন্ত বিলাপ,সাত পাকে বাঁধা, অশনি সংকেত, আতঙ্ক, অন্তর্ধান, ঘরে বাইরে গন শত্রু, শাখা প্রশাখা, অগ্রদানী এবং আরও অনেক অনেক ছবি।আর অতি অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ের ছোট দের নানা ছবিগুলোতে ফেলুদার চরিত্রে তিনি সদা ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
তদানীন্তন সময়ে আপামর বাঙালির প্রাণের রোমান্টিক অভিনেতা ছিলেন উত্তমকুমার। উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর অভিনয়ের প্রতিযোগিতা চলতো। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে অথবা রকের আড্ডায় অথবা ঘরে ঘরেও এই নিয়ে বেশ তর্ক বিতর্ক চলতো এই দুজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? অনেকটাই যেন ইস্ট বেঙ্গল মোহনবাগানের খেলার মতো।আজ আমরা তাঁর শেষ যাত্রা র যে ছবি টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি উত্তম কুমারের মৃত্যুতেও সমগ্র কোলকাতা শহর এবং টালিগঞ্জ পাড়াভেঙে পড়ে ছিল মহানায়কের মহাপ্রয়াণে।
উত্তম কুমারের সঙ্গে একত্রে তিনি দু একটি ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন। যেমন ঝিন্দের বন্দী , স্ত্রী পরবর্তী কালে দেবদাস ইত্যাদি।
তাঁকে সত্যজিৎ রায়ের মানসপুত্র বললেই বোধহয় একেবারে সঠিক বলা হবে। অপুর সংসার ছবিটির শেষ দৃশ্যে যখন অপু তার ছোট্ট ছেলেটিকে ঘাড়ে বসিয়ে নিয়ে আসছে নিজের কাছে অথবা শাখা প্রশাখা ছবিটির মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির অভিনয় কিংবা অগ্রদানীর সেই ব্রাহ্মণ যে নিজ পুত্রের পিন্ড নিজেই ভক্ষণ করে ছিলেন,সেই শরীরে শিহরন জাগানো দৃশ্যগুলি কি ভোলা যায়?
তাছাড়া নাটক যাত্রা পালা কবিতা সবকিছুতেই তাঁর ছিল অনায়াস বিচরণ। তাই তিনি তাঁর দক্ষতার পুরস্কার স্বরূপ পদ্ম ভূষণ দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
তখনকার সামাজিক জীবনের পটভূমিতে বাড়ি থেকেও সিনেমায় যাওয়াটা অভিভাবকেরা খুব একটা পছন্দ করতেন না। টেলিভিশন মোবাইল এর কথা তো কারো ধারণার মধ্যেই ছিল না। সরাসরি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখাই ছিল রীতি।
আর ছবি রিলিজ এর প্রথম দিনে প্রথম শো দেখা ছিল একপ্রকার যুদ্ধ জয়ের সামিল।
এই রকম ভাবে অশনি সংকেত ছবি টি যখন মিনার বিজলী ছবিঘরে প্রথম মুক্তি পেল সেদিন পরিবারের সঙ্গে আমি ও গিয়ে ছিলাম ঐ ছবি টি দেখতে। কিরকম অদ্ভুদ ভাবে তিনিও সেদিন বিজলী প্রেক্ষাগৃহে উক্ত ছবি টি দেখতে এসেছিলেন। হঠাৎ দেখি তিনি ব্যালকনির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছেন তাঁর নিজের ই অভিনীত ছবি দেখে। তখন তিনি একেবারে দীর্ঘদেহী অতীব গৌরবর্ণ এক যুবক। তিনি বাইরে এসে কিছু সময় অন্যান্যদের সাথে কথা বলে নিজের গাড়িতে উঠে চলে গিয়েছিলেন।
আমার সঙ্গে তাঁর কোনো দিন ও কোন ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না ঐ একদিন ই মাত্র তাঁকে আমি দেখেছিলাম এবং যা আমার মনের স্মৃতি মন্দিরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
পরবর্তী কালে , সেটাও অনেক পরে তাঁর অভিনীত লাঠি ছবিতে তাঁর মরদেহের একটি দৃশ্য ছিল যা আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। জীবন থাকলেই আছে মৃত্যু। জীবনের গতিপথ ধরে মৃত্যুও চলে সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দ চরণে।আজ যেন লাঠি ছবিটির সেই দৃশ্যটি ই সত্যি হয়ে উঠলো। বাংলা ছবির জগতের আর একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি আনন্দলোকে যাত্রা করলেন।
আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি—–
কবিগুরুর ভাষায় তাঁর লাগি বলি ****
কর্মভার নব প্রাতে
নবসেবকের হাতে
করি যাবো দান
মোর শেষ কন্ঠ স্বরে
যাইবো ঘোষণা করে
তোমার আহ্বান।।
~কলম বন্দনা সাহা।
মুকুন্দপুর।
১৫-১১-২০।