স্বপ্নের প্যারিস এবং আইফেল টাওয়ার
এই বিশাল পৃথিবীতে কত দেশ মহাদেশ ও কত সভ্যতা রয়েছে তা বুঝি এক জনমে দেখে ওঠা সম্ভব নয়।দেশ বিদেশের ভ্রমণের আনন্দ অনুভূতি গুলো যেন সোনার খাঁচায় বন্দী করে রাখা মনি মানিক্যের পসরা। এই স্বল্প পরিসরে আমার প্যারিস ভ্রমণের স্বল্প অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করি। ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ঘুরতে ঘুরতে আমরা সুইজারল্যান্ড থেকে সকাল সাতটায় বাসে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রায় সাত ঘন্টার পথ।বাসে আমরা সকলেই ভারতীয়। আমাদের বাসের ড্রাইভার জন ভারতীয় রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি না বুঝলেও কখনো দুই হাত জোড় করে নমস্তে জানাতে ভোলেন না। রৌদ্রজ্জ্বল দিনে আমরা সবাই মহা হুল্লোড়ে দুদিকের সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চললাম।
পথে খুব ট্রাফিক জ্যাম। এই কারনে প্যারিস পৌঁছতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখানে পৌঁছে যেটা মনে হল আমাদের কলকাতার রীতি নীতির সঙ্গে ফ্রান্সের রীতি নীতির বেশ মিল আছে। কিছু কিছু জায়গায় ভোটের দেওয়াল লিখন রয়েছে যদিও তা খুব ব্যাপক নয়।
প্যারিসে সান্ধ্য ভ্রমণে যাওয়ার জন্য আমরা গ্রুপের সকল ভারতীয়রা একটি খুব সুন্দর ঝকঝকে তকতকে বাসে উঠলাম। রাতের প্যারিস সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।আলোয় ঝলমলে রাতের রানী প্যারিসের হোটেল, দোকান, বাজার, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, পথঘাট, ফোয়ারা সব কিছু। আমরা সবাই দারুন আনন্দ নিয়ে এ পথ সে পথ ধরে চলছি। রাতের আলোয় উদ্ভাসিত প্যারিস যেন সাতরঙা রামধনুর মতো উজ্জ্বল। বাসের ভেতর থেকে ই যতটা সম্ভব ছবি তোলা যায় তুলছি। দুধারে বড় বড় ঐতিহ্যবাহী ইমারত এবং বহু পুরাতন দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন রয়েছে।

এরপর আমরা ঘুরতে ঘুরতে সেখানকার সময় অনুযায়ী রাত এগারোটায় “আইফেল টাওয়ারের” বিশাল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এসে পৌঁছলাম। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। দেখলাম টাওয়ারটির ওপরে থেকে নীচ পর্যন্ত আলোয় আলোকিত। কত দীর্ঘ, ওপর দিকে তাকিয়ে দেখতে হয়। আমরা”আইফেল টাওয়ারের”অপূর্ব সুন্দর কারিগরি দক্ষতা দেখে বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে আছি।আলো ঝিলমিল ঝিকমিক”আইফেল টাওয়ার”। সেই কোন যুগে তা বানানো হয়েছে তা আজ ও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।এই টাওয়ারের ওপরের অংশটি হল টিভি টাওয়ার। যখন রাত বারোটা বাজলো তখন টাওয়ার টির ওপরের অংশ থেকে কিছুটা নীচ পর্যন্ত অসংখ্য তারার মতো আরো আলো জ্বলে উঠলো। পনের মিনিট পর্যন্ত জ্বলা নেভা সেই আলোগুলিকে সমষ্টিগত নক্ষত্রের ছায়াপথ বলে মনে হতে লাগলো। দুই চোখে ভরে নিলাম সেই সৌন্দর্য। পনের মিনিট পর সেই আলোগুলি কে নিভিয়ে দেওয়া হলো। সেই প্রাঙ্গণে দেখলাম অনেক কৃষ্ণবর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষ নানান রকম দ্রব্য বিক্রয় করছে। অনেক রাতে রাতের “আইফেল টাওয়ার”এবং রাতের প্যারিস দেখে হোটেলের ঘরে ফিরলাম।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে প্যারিস এ মেয়েরা অনেক রাত পর্যন্ত একা একা ই ঘোরে । ওরা ভারতীয় নারীদের থেকে অনেক বেশি আত্মনির্ভর তাই হয়তো। পথে সাইকেল এবং দুজনের বসার জন্য অনেক গাড়ি দেখা গেল।

আরসি দে ট্রিওমফে গেট

লৌভরে মিউজিয়াম
পরের সকালে প্রাতরাশ সেরে এবার দিনের আলোয় প্যারিস ভ্রমণের জন্য বেরোলাম। পথে যেতে যেতে সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক ইমারত, অফিস, গীর্জা, লৌভরে মিউজিয়াম, অপেরা হাউস, ফ্যাশন শো হাউস ইত্যাদি দেখলাম। সবকিছুর নির্মাণে প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে। আমাদের বাসের গাইড সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এক জায়গায় দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের মতো একটি আরসি দে ট্রিওমফে গেট আছে। আর এক স্থানে দেখলাম সারি সারি উচ্চতার “চেসনাট” ট্রি। দিনের আলোয় আবার দোকান বাজার দেখতে দেখতে আবার পৌঁছলাম আইফেল টাওয়ারে র প্রাঙ্গণে দিনের আলোয় এর অন্যরকম সুন্দরতা দেখবার জন্য। দিনের বেলায় স্পষ্ট দেখা গেল এর চারিদিকের বিপুলতা। নীচে অফিসে পাসপোর্ট চেক করিয়ে “আইফেল টাওয়ারে”র ওপরে ওঠা। টাওয়ারের গা ঘেঁষে রয়েছে লিফ্ট যাতে করে আমরা এর ছ’তলা পর্যন্ত উঠলাম। এখানে টেকনোলজি সবই উন্নত মানের। টাওয়ারের এক একটি বিশাল বিশাল তলায় দোকান রেস্তোরাঁ সব রয়েছে। টাওয়ারের চারপাশে লাগানো রেলিং থেকে বহু দূর বহুদূর অবধি দেখা যায়। সবচেয়ে ভালো লাগে ঘাসের ওপর হলুদ সাদা রঙের ফুল ফুটে থাকে। তাছাড়া পথের পাশে পাশে নানা রঙের ফুলের বাহার তো আছেই।কত সুন্দর করে সবকিছু সাজানো।
এইভাবে অনেকক্ষন পর্যন্ত “আইফেল টাওয়ার”দেখে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে “বাঁতে মুশ ক্রুজে” করে নৌকা বিহারের জন্য রওনা হলাম। নদীর দুই তীরে দুই রকম সভ্যতার ছোঁয়াচ। একদিকে প্রাচীন শিল্পকলা ও অপরদিকে আধুনিক সভ্যতার বিকাশ। এক জায়গায় দেখলাম নদীর মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত “স্ট্যাচু অব লিবার্টি”র একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। অনেকটা সময় নদী বক্ষে ঘুরে আবার উঠে বসলাম হোটেলে ফেরার জন্য।

গাইডের মুখে শুনলাম এখানকার জীবন যাপন খুব ব্যয়বহুল। অনেকেই চাকরি করে যা বেতন পান তা দিয়ে অনেক সময়ই চলে না,তাই তারা বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন।যাঁরা এখানে প্লাম্বিং এর কাজ করেন তারা নাকি খুব সম্মান পান এবং তারা খুব প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। একটি নোতুন কথা জানতে পারলাম।
আমরা সকল ভারতবাসীরা খুব আনন্দ করলাম।পরের দিন দুপুরের দিকে প্যারিসের এয়ারপোর্ট থেকে সবাই মিলে মুম্বাই গামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে চড়ে নিজের দেশের দিকে যাত্রা করলাম।
অনেক পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা মুম্বাই এর ছত্রপতি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম তখন আবার সকল ভারতীয়রা পরস্পর ভাব বিনিময় করে যার যার নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম।
সেই সঙ্গীদের সাথে আর কোনও দিনও দেখা হবে না তবুও অন্তরে রয়ে যাবে এর স্মৃতি সুধার করুনাধারা যা হয়ে থাকবে চলার পথের পাথেয়।